'পাগল' শব্দটা মুখ দিয়ে বের করে কোথায় পাঠিয়ে দাও? -
"পাতা থেকে গাছ ঝরছে- এই দৃশ্য দেখার চোখ
অ্যাসাইলামে জেগে থাকে;
খিদা লাগলে চুলা আর
পিপাসা লাগলে আকাশের দিকে পানি ফেলে দিয়ে গেলাস খায়।
প্যাকেট থেকে আঙুল বের করে ধরায়, টানে- ছাই জমে উঠলে ঝেড়ে ফ্যালে; আবার টানে।
[ভাগ্যবান নামের একজন স্লিপ-ওয়াকার আমারে বলেছিল এইগুলো লিখে রাখতে, জুন ২০১৮]"
শেষশৈশবে, ইংলিশপ্যান্ট [হাফ-প্যান্ট] পরার খুলনাবেলায়, ফ্যামিলির নিষেধ-বাউন্ডারি গোপনে ক্রস করতে পারার শুরুর দিকে, প্রথম আমি পাগল (?) দেখি- এলোমেলো লম্বা-ঝাঁকড়া-চুলের, প্রায়-শাড়ির-মতো-কইরা ছালার চট পরা তেল-কালি-লাগার চাইতেও বেশি ময়লা-লাগা একা-একা আধা-ল্যাংটা খালি পা একজনার হেঁটে যাওয়ার পিছন-পিছন ডাইনে-বামে আমার সমান, আমার চেয়ে বেশি-বয়সী অনেকগুলা পোলাপাইন যাইতাছে আর 'পাগল' 'পাগল' বইলা চেঁচাইতাছে, মিছিল করতাছে; নষ্ট-হইয়া-উইঠা-যাওয়া পাকা রাস্তার ছোট ছোট পাথর, খোয়া, রাস্তায় পইড়া পাওয়া সিগারেট, ম্যাচের খালি প্যাকেট, কাগজ দলা পাকাইয়া তার দিকে ছুইড়া মারতাছে-
কোনোটা তার গায়ে লাগতাছে, কোনোটা লাগতাছে না- লক্ষ্যবস্তু কারো দিকে না তাকাইয়া বিভিন্ন স্কেলে 'তোর বাপ পাগল', 'তোর মা পাগল', 'তোর ভাই পাগল', 'তোর বইন পাগল', 'তুই পাগল','তোর চোদ্দগুষ্টি পাগল'-এর এলোমেলো পুনরাবৃত্তি করতে-করতে যাইতেছে তো যাইতেছেই- আমিও ঝাঁকের কৈ-র পিছনে, কিছুদূর আগাইয়া গিয়া প্রাথমিক-স্কুলপাঠ্যের 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'র কথা মনে পইড়া যাওয়ায় ঝাঁকছুট হইছিলাম।
এর পর ওই রকম আর পুরা-ল্যাংটা, পৌনে-ল্যাংটা, আধা-ল্যাংটা কত পাগল(?) দেখছি, দেখতেছি। একবার একজনাকে একটা রাস্তা তাঁর নিজের গতিতেই পার হইতেছে দেখছিলাম, ফলত রাস্তায় জ্যাম; সে পার হবার পর ছোটে। আরেকবার, সর্বোচ্চ সিকিউরিটি ক্রস করে একজনা ঢুইকা পড়ছিলেন একটা ভবনের নিচতলার অনেক ভিতরে এবং একজনের টেবিলে বইসা দুপুরের খাবারসহ-প্লেট টাইনা নিয়া ছুইড়া ফালায় দিতে আর ফালায়দাতাকে অনেকে মিলা উঁচা কইরা ধইরা বাইর কইরা দিতেছে, দেখছিলাম। অন্যবার দেইখা ফালাইছিলাম- যার সঙ্গে অসংখ্যের সমীহ করে চলতে, বলতে হয়; রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়; এমন একজন কেউকেটা পাগলের চইলা আগাইবার রাস্তা ছাইড়া দিছিলেন আর পাগল কয়েক পা আগাইয়া গিয়া ফিরা আইসা তারই মুখমণ্ডলে ছ্যাপ মাইরা আগের গতিতেই আগাইয়া গেছিলেন।...দেখার শেষ অন্ধ হইলেও যাবে না।
মানুষ ও অন্যান্য গৃহপালিত অথবা মুক্ত জীব, কে কেন পাগল বা পাগল হয়, কত প্রকার কী কী হয়- এই ভাবনা, গবেষণা, চিকিৎসা ইত্যাদি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের। বিশেষজ্ঞের পাগালামির গবেষণা ইত্যাদির নিশ্চয় বিশেষজ্ঞ আছেন।
'হাওয়া বলছে পাগল হবো,
তোমাকে পাগলি বানাবো;
আমি তো সেই কবে নেমেছি,
তোমাকে এইবার নামাবো পথে-
একা-একা ভাল্লাগে না চড়তে উল্টোরথে।
[বয়সের ১৪/১৫'য় গানের জন্য লেখা- ২০০৪-এর পরে সঞ্জীব চৌধুরীর সুরে,বাপ্পা মজুমদারের কম্পোজিশনে গাইছিলেন হাসান মাসুদ]
ছেলেবেলায় পা, হাত, মন, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি দিয়া আগ-বাড়াইবার সময় একটা একতরফা পিরিতের চিপায় পইড়া আমিও অনেকদিন পৃথিবীবিস্মৃত ছিলাম। একতরফার কাহিনী অংশত একটা সিনেমায়, কয়েকটা ভিডিও-ফিকশনে, প্রিন্ট ও ভিজ্যুয়াল-মাধ্যমে [ইন্টার্ভিউতে] এতবার জানাইছি যে, যারা জানেন, তাদের কেউ, অনেকে এই লেখাটা পইড়া বসলে, এই অনুচ্ছেদে আইসা আপনমনে বইলাও উঠতে পারেন- 'আবার!'।
'পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে/...'
-রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর
এক আধা-সরকারি জুটমিলের থার্ডক্লাস ওয়ার্কারের পোলা আমি সেই মিলেরই অন্য শাখার ফার্স্টক্লাস-অফিসারের মাইয়ারে ভালোবাইসা ফালাইছিলাম; ফালাইয়া নিজের স্কুলফিস্কুল ভুইলা গিয়া সেই মাইয়ার স্কুলে যাবার পথের পাশের এক কাঠগোলায় বইসা, স্কুল শুরু হবার আগের টাইমে, ছুটির টাইমে; স্কুলের গেটে গিয়া; খুলনার দৌলতপুরের প্রধান বাসস্টপের কাছে তার গান-শেখার দোতালা-স্কুলের নিচে [সেই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম দিনই বাতিল হইয়া গেছিলাম সারেগামার 'জোরে সা'-বিষয়ক জটিলতায়], তার কোচিং [একবার কোচিং-প্রধানরে রাস্তায় পাইয়া জানতে চাইছিলাম, 'আমারে একটু কোচিং করাবেন?' উনি বলছিলেন, 'আমার এখানে অংক ছাড়া আর কোনো বিষয় নাই', 'আমি অংক করতেই আসবো' বলায় তিনি 'দেখি' বইলা চইলা গেছিলেন। এর পর সেই স্যারের সঙ্গে যতবার দেখা হইছে ততবারই 'দেখি' শোনার পর একদিন একটা খাতা নিয়া কোচিং সেন্টারে গিয়া হাজির হইলে সেই স্যারের ঝাড়ি খাইয়া ফেরত আইছিলাম] করতে যাওয়ার রাস্তায় ভাইগ্নার চা-সিগারেট-টোস্ট বিস্কুটের দোকানে বইসা দাঁড়াইয়া তারে দেখা, ফলো করার প্রায় দেড় বছর পর আমার এই ব্যাপারটা এলাকার নানান জায়গায় বেশি জানাজানি হবার পর আব্বা একটা অফিসিয়াল চাপ খাইছিল। ওই মাইয়ারে ফলো-করা ছাড়তে হবে, না হইলে আব্বা চাকরি হারাবে- এমন এক 'নো ম্যান্স ল্যান্ড'-এ লক খাইয়া এমন হইছিলাম, সেই লকের নামকরণ করা হইছিল, 'পাগল'। আমি আব্বার চাকরিসূত্রে পাওয়া টিনশেডের লম্বা স্টাফ কোয়ার্টারের একবারান্দা, একঘরে দীর্ঘদিন আটকা ছিলাম- নানান উপায়ে [উপায় লিখলে পুরা 'কালের খেয়া' লাইগা যাইতে পারে।] লক ছোটার পর জানলাম, বন্ধুরা আমারে জানলা দিয়া দেখতে আসতো। খাবার দিলে সিগারেট চাইতাম, আব্বা আমারে সিগারেট আইনা দিত। একবার নাকি কীভাবে ঘর থেকে বাইরাইয়া গিয়া কোয়ার্টারের পিছনের অনেক জায়গা জুইড়া বেড়া-দেয়া-কলমি গাছ রামদা দিয়া কাইটা উজাড় কইরা দিছিলাম [লেট এইট্টিজে মারামারিতে আমাদের ওই অঞ্চলে রামদা, ক্ষুর, সেভেন গিয়ার, চায়নিজ কুড়ালের প্রচলন থাকায় সচেতন-সিনিয়রদের কাছে 'গোল্লায় যাওয়া' আমার সংগ্রহেও কোনো-না-কোনোভাবে ওই ধারালো জিনিস ছিল]। আমি অনেকদিন কোনোরকম সবুজ রঙ সহ্য করতে পারতাম না কারণ, আগেও জানতাম না;এখনো জানি না,তবুও মাঝে-মাঝে সবুজ দেখলে এখনো একটু অসহ্য লাগে। একবার ঢাকার এক মেসে থাকার সময় একজনের একটা কড়া-সবুজ বিছানার চাদর বঁটি দিয়া কুচায়া ফেলছিলাম। সেইটা নিয়া অনেক কাহিনী এবং মেস-ছাড়া। সহ্য আনার জন্য আমি নানানরকম সবুজ টি শার্ট পরতাম, পরি, পরবো।... এই লেখার এইখানে আইসা ৮ দিকে তাকাইয়া তিরোধিত আব্বার কাছে একবার 'সরি' চাওয়া যাক- 'সরি আব্বা'।
ফুল ছিঁড়ে নিয়ে গেছে কেউ,- আমি এখন বোঁটা ছিঁড়বো
[হাতে না পারলে দাঁতে]?
'পাগল' শব্দটা মুখ দিয়ে বের করে
কোথায় পাঠিয়ে দাও?
[আমার কবিতাবই 'বাইজিবাড়ি রোড'-এর 'কেউ ফেরে না খালি হাতে, আমিও']
ম্যাডনেস ও ক্রিয়েটিভিটি
'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।/...
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে.../
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে/...।'
-কাজী নজরুল ইসলাম
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়ায় [২৪ মে, ১৮৯৯ ] জন্মাইয়া মহান দারিদ্র্যর আশীর্বাদে [?] ছেলেবেলাতেই রুটির দোকানে কাম, আজান দেয়া, কবরস্থানের খাদেম, লেটোর দলে গানবাজনাসহ [সোকল্ড রাইজিং আরবানরা যেসব কাজরে নাক সিটকাইয়া 'অড জব' কইয়া থাকে] নানানরকম জীবনযাপনের ভিতর দিয়া প্রেম, কবিতা, গান [সুর, সঙ্গীত, সঙ্গীতের অজস্র রাগ সৃষ্টি], গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, প্রকাশনা, সিনেমা, রাজনীতি, রেডিও, জেলজুলুম-নির্বাচন-হুলিয়াসহ অনেক-কিছু করার মতো কইরাই কিংবদন্তি কাজী নজরুল ইসলাম। পাগল না হইলে অত-কিছু করা যায়? গান দিয়া পরমপুরুষের স্ববিরোধ [ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে] নানান জায়গায় আঙুল দিয়া দেখায় দেয়া যায়? বিদ্রোহ কইত্তে আসে? অত-কিছু করা যায়? লেইখা-বলা যায়,- 'আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ',... 'আমি মানি না কো কোন আইন', 'খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর',...'আমি ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন'...?
আমার ধারণা [কারো-কারো কাছে বালসুলভও লাগতে পারে], অত-কিছুর লোড নেয়ায় ১৯৪২-এ 'সাম্যের গান গাওয়া' নজরুল সিক হইয়া পইড়া কথা-বলতে-পারার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলায় হোমিওপ্যাথি,আয়ুর্বেদের চিকিৎসা-চালুর ভিতর একই বছর-শেষে মানসিক ভারসাম্যও হারান। চিকিৎসা কমিটিটমিটি হয়- প্রথমে লন্ডন, পরে ভিয়েনার চিকিৎসায় জানা যায়, কবি 'পিক্স ডিজিজ' নামে নিউরনঘটিত সমস্যায় ভুগতেছেন- এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিস্কের ফ্রন্টাল ও পাশের লোব সংকুচিত হয়। ১৯৭২-এর ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়া নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয় এবং তাঁর ভারসাম্যহীন-মস্তিস্কের জীবন বাংলাদেশে কাটতে থাকে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাবার পরেও মিনিমাম স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে আর ফেরানো যায় নাই। ১৯৭৬-এর ২৯ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। এই ১৯৭৬-এই নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার সরকারি আদেশ জারি হয়।...
পাগল বোঝে পাগলরে
নজরুলের জীবন আর কাজের প্রভাব তাঁর পরবর্তী প্রায় প্রত্যেক বাঙালি কবি-লেখকের, পাঠকের জীবনে এবং কাজে ছিল, আছে, থাকবে। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতার বই 'ঝরা পালক' নজরুলপ্রভাবধন্য।
হিন্দি সিনেমার উর্দু-হিন্দি লিরিসিস্ট, ফিল্মমেকার, চিত্রনাট্যকার- ২০০৮-এ 'জয় হো' লিরিক্সের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-পাওয়া গুলজার- ভিজুয়াল এক ইন্টার্ভিউতে বলছিলেন, তাঁকে নজরুলের লেখা কীভাবে ইন্সপায়ার করছিল। ... রবীন্দ্রনাথের একটা বই [উর্দু তরজমা] তাঁর জীবন কীভাবে বদলাইয়া দিছিল। ...শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সুবোধ [ঘোষ]-দের পড়ার জন্যই তিনি বাংলা শিখেছিলেন। তাঁর বানানো সিনেমার অধিকাংশই বাংলা সাহিত্যের এইসব মহারথীর গল্প-উপন্যাসনির্ভর।
এই অধমও ছেলেবেলার পাঠ্যপুস্তকে অন্যদের পাশাপাশি নজরুলরেও খালি পরীক্ষাপাশের জন্য না-পইড়া নিজেরে পড়াইছিলো বইলা, একাডেমিক শিক্ষারে সাইড কইরা নিজের রাস্তা নিজে বানাইয়া, সেই রাস্তায় চলতে-চলতে মন-শরীরের ৪৫+ ঝঃধঃরড়হ-এ আইসা এই লেখা লিখতে পারার ট্রাই করলো।
'.../ সকল লোকের মাঝে বসে /আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?/...'
[বোধ (কবিতা-অংশ), জীবনানন্দ দাশ]
বাংলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মাইছিলেন বরিশালে [১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯]। তারপর অনেকবার কোলকাতা-বরিশাল-কোলকাতা করার ফাঁকে বিয়া করছিলেন পুরান ঢাকায়। সো কল্ড কেরানি হইয়া না-যাওয়ায় তাঁর কর্ম ও বৈবাহিক জীবনে অস্বস্তি ছিল। নিজস্ব জীবনযাপনের ধরন, লেখকের জীবনদর্শন [ভালো লিখতে হলে, অন্তত এখন পর্যন্ত এ-দেশে, বেঁচে থাকবার সহজ সাফল্যগুলো সব ছাড়তে শিখতে হয়, অনেকটা কাপালিকের মতো হয়ে যেতে হয়। সামনে কিছু নেই, থাকবার আশাও নেই, কিন্তু তুই তবু থেকে যাচ্ছিস বা থাকবার জন্য আপ্রাণ করছিস।...'- ভূমেন্দ্র গুহকে [যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শস্ত্র চিকিৎসায় মাস্টার অব সার্জারি, বিশেষভাবে 'বক্ষদেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হূৎপিণ্ড ও সর্বশরীরের ধমনী-শিরার শস্ত্র চিকিৎসাবিদ্যায় এম.সি-এইচ; কবিতা, প্রবন্ধ লিখছেন; অনুবাদ করেছেন, বিখ্যাত 'ময়ুখ', 'অনুক্ত' পত্রিকা সম্পাদনায় সংশ্নিষ্ট ছিলেন; জীবনানন্দের মৃত্যুপরবর্তী প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনা সংবলিত বইগুলা প্রকাশ করায় ভূমিকা রাখছেন] জীবনানন্দ।] আর কবিতায় নিজের ভাষা-পথ নিজে বানাইয়া নেয়ায় তাঁর সমসাময়িক অনেকেই তাঁকে নিয়ে উপহাস, তাচ্ছিল্য ইত্যাদি করত- সেসব শুধু মুখে মুখে বা আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকত না, লিখেও তারে আহত করা হইছে- 'পাগল' বইলাও ডাকা হইছে আমরা বুঝতে পারি।
আলাদা লিখলেই পাগল! আলাদা বা নিজস্ব জীবনযাপনপদ্ধতিতে কেউ বাইচা থাকতে চাইয়া পারলেই সে পাগল!...জীবনানন্দবিষয়ে অনেক বই পড়া থেকে জানা যায়, কবিতায় তাঁর সমকালীন ও পরবর্তী জেনারেশনের অনেকে, যারা তাঁরে নানানভাবে অপমানসহ এড়াইয়া চলছিলেন, তাদের বড় একটা অংশ পরে একে একে তাঁর কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনাকে প্রাতঃস্মরণীয় করে বেঁচে ছিলেন, আছেনও কেউ-কেউ। 'অচেনা লেখা যে লিখবে সে পাগল'- যে বা যাঁহারা (সেইসব শেয়াল) এইসব নির্দিষ্ট কইরা দিয়া মরছেন, তাদের ভূত দুনিয়া জুইড়া শেষপর্যন্ত থাকবে।
কাকে তুমি ডাকো ফুল? নিশ্চয় আমাকে।
কাকে? আমি এই ঘরে থাকি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে
তেইশ ঘণ্টাই একা একা, বাকি এক ঘণ্টা থাকি
বাড়ির বাইরে ওই চায়ের দোকানে
মেলামেশা করি সব দেবতাদিগের সঙ্গে।
[আমিই গণিতের শূন্য, বিনয় মজুমদার]
বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়া কথা-লেখার সাহস আমার নাই; হবেও না আগামীতে। বাংলা ভাষার সাধারণ পাঠকের চেয়ে তাঁর কবিতা, দর্শন, জীবনযাপন তাঁর সময়ের ও পরের পরের পরের প্রজন্মের কবি-লেখকদের কাছে ক্রমবর্ধমান কিংবদন্তি। তাঁর প্রথমদিকের কবিতায় জীবনানন্দ দাশের প্রভাব থাকলে অসুবিধা কী?
বার্মার [এখন মিয়ানমার] মিকটিলা জেলার তেডো শহরে ১৯৩৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বরে জন্মান- পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আক্রমণে আতঙ্কিত পরিবার উদ্বাস্তু হইয়া বার্মা ছাইড়া মাতৃ-পিতৃভূমি অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের [এখন তো বাংলাদেশ] ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার [এখন জেলা] মাঝিগাতি-তারাইলে আইসা ওঠেন। এইখানকার বৌলতলি উচ্চ ইংরেজি স্কুলে পড়ার সময়ে, ১৩ বছর বয়স থিকা কবিতা লেখা আরম্ভ করেন; ১৯৪৭ সালে এই স্কুলের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪৭-এর এক সময় মাঝিগাতি-তারাইল থিকাও চইলা যাইতে হয় পশ্চিমবঙ্গের শিমুলপুরে-...
বিনয়ের প্রথম কবিতার বই 'নক্ষত্রের আলোয়' [১৩৬৫ বঙ্গাব্দ],পরেরটা 'গায়ত্রীকে' [২৪ ফাল্গুন, ১৩৬৭] ১৯৬৪-তে 'দ্য স্টেটসম্যান' দৈনিকে বিনয়ের কবিতার তৃতীয় বই 'ফিরে এসো চাকা' নিয়া আলোচনা প্রকাশিত হওয়ার পর কোলকাতায় হইচই পইড়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হইয়া যায়। রুশ ভাষার ৫টা বই অনুবাদ কইরা খ্যাতি অর্জন করছিলেন এরও অনেক আগে।
১২ বছরের 'গায়ত্রী'র প্রেমে একতরফা পইড়া থাকতে-থাকতে ২৩ বছর বয়সে ইংরেজি এম.এ.তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইয়া ফেলোশিপ পাইয়া গায়ত্রী উত্তর-আমেরিকায় চইলা গেলে বিনয়ের আচরণে বদল দেখা দেয়। 'ফিরে এসো চাকা' বের হবার আগেই কবি মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া আচরণে অসংলগ্নতা শুরু করেন- কোনো চিকিৎসাই তাঁর তিরোধানের আগেও সেইটা সংলগ্ন করতে পারে নাই।
তাঁরে নিয়া হাসিঠাট্টা করায় ১৯৭১-এর কোনো-একদিন বিনয় মেসের ঠাকুরের [ম্যানেজার] মাথায় দরোজার খিল ছুইড়া মারলে তার মাথা ফাইটা যায়। পুলিশ আইসা বিনয়রে অ্যারেস্ট কইরা চালান দিয়া দেয়।
পৈতৃক ভিটার টানে সীমান্ত আইন না মাইনা ভিসা, পাসপোর্ট-ফাসপোর্ট ছাড়া একবার বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুইকা পইড়া ৬ মাস জেল খাইটা ফেরত গেছিলেন- এই সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণও করতে চাইছিলেন [পরে আর করেন নাই]। চিকিৎসার নামে তাঁর স্বজনরা [?] বারবার মানসিক হাসপাতালে [অন্তত ৮ বার] নিয়া গিয়া রাইখা আইছে বিনয়রে- ১৮ বার ইলেকট্রিক শকও দেয়া হইছে তাঁরে। একবার বিড়ি খাইতে-খাইতে জ্বলন্ত বিড়ি ছুইড়া মারছিলেন মশারিতে- আগুন ধইরা গেছিল- পরপরই বিনয়কে আবারও অ্যাসাইলামে যাইতে হয়।...
একবার তাঁকে এক মানসিক হাসপাতালে ঠেইলা পাঠাইলে দেখা হইয়া যায়, তাঁর আগে গিয়া থাকা ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। এই হাসপাতালেই ঋত্বিক তাঁর রচিত-নির্দেশিত 'জ্বালা' নাটক মঞ্চস্থ কইরা বিনয়রে দিয়াও অভিনয় করান। ...বিনয় সম্পর্কে এইরকম ইনফো বহুত দেয়া যায়। আর পারতেছি না, খারাপ লাগতেছে।
ওই অবস্থার ভিতরেও পরপর বিনয় লেইখা রাখছেন কবিতার বই 'অধিকন্তু', 'অঘ্রানের অনুভূতিমালা', 'ঈশ্বরীর', 'বাল্মীকির কবিতা', 'আমাদের বাগানে', 'আমি এই সভায়', 'আমাকেও মনে রেখো', 'আমিই গণিতের শূন্য', 'এখন দ্বিতীয় শৈশবে', 'কবিতা বুঝিনি আমি'; গদ্যের বই 'ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ ও অন্যান্য', 'ধূসর জীবনানন্দ'।
বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, রুশ, সিন্ধি, বর্মা ভাষা জানা, গণিতশাস্ত্রের চর্চা করা, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গোল্ড-মেডেলিস্ট, ইঞ্জিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করা কবি বিনয় মজুমদার তাঁর জীবনের করুণ পরিণতির জন্য 'হাঙর'দের দায়ী করে গেছেন এক সাক্ষাৎকারে- 'হাঙর মানে মনস্তত্ত্ববিদ, হাঙর মানে ডাক্তারগণ, হাঙর মানে পুলিশগণ, হাঙর মানে মন্ত্রীগণ, হাঙর মানে পুরোহিতগণ। এই হাঙরদের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বেরিয়ে আসার জোগাড়।'... 'ওরা সব ভ ুল করে দিয়েছে'... এর সঙ্গে আছেন সমাজপতি, কবিতাপতি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। আড়াই মাস ধরে কবি মৃদুল দাশগুপ্তর নেয়া এই সাক্ষাৎকারের অল্প অংশ ছাপা হইছিল 'নৌকা' নামের লিটলম্যাগে।
যৌক্তিক সত্যিকথা যে বলে, সে পাগল
'তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।'
-লালন ফকির
লেখাটা মগজে যেইভাবে কমপ্লিট হইছিল, সেইভাবে লেইখা কমপ্লিট করতে পারলাম না।
মগজে এসএম সুলতান ছিল, ছিল ঋত্বিক ঘটক, ভ্যানগগ, বোদলেয়ার, র?্যাঁবো, গ্যালিলিও, মির্জা গালিব, জিম মরিসন, শোয়েব শাদাব, মাহমুদুল হক, ফ্রানজ কাফকা, লালন ফকির...
ওনাদের বা ওনাদের মতোন আরো অনেকরে নিয়া উল্লিখিত-রকমে লিখতে গেলে আমার মতো কাছিমের দীর্ঘ দিনরাইত লাগবে।
ধন্যবাদ চাঁদ-সূর্যকে, মেঘ-বৃষ্টিকে, গরমকে, ইলেক্ট্রিসিটিকে, ল্যাপটপকে, গুগলকে, ২ আঙ্গুল দুধ-চা ও সিগারেট-আগুনকে, অজস্র বই-পত্রপত্রিকাকে, লাচ্ছা সেমাইকে, চানাচুরকে, কলাকে, আমকে, ডাবকে...এবং আরো যাদের কথা মনে পড়তেছে, লিখতে পারতেছি না- আমারে প্রায় ৭২ ঘণ্টা জাগাইয়া রাইখা আলস্যসহযোগে এই লেখাটা এইভাবে লিখতে সাহায্য করার জন্য সবাইরে ধন্যবাদ।
অ্যাসাইলামে জেগে থাকে;
খিদা লাগলে চুলা আর
পিপাসা লাগলে আকাশের দিকে পানি ফেলে দিয়ে গেলাস খায়।
প্যাকেট থেকে আঙুল বের করে ধরায়, টানে- ছাই জমে উঠলে ঝেড়ে ফ্যালে; আবার টানে।
[ভাগ্যবান নামের একজন স্লিপ-ওয়াকার আমারে বলেছিল এইগুলো লিখে রাখতে, জুন ২০১৮]"
শেষশৈশবে, ইংলিশপ্যান্ট [হাফ-প্যান্ট] পরার খুলনাবেলায়, ফ্যামিলির নিষেধ-বাউন্ডারি গোপনে ক্রস করতে পারার শুরুর দিকে, প্রথম আমি পাগল (?) দেখি- এলোমেলো লম্বা-ঝাঁকড়া-চুলের, প্রায়-শাড়ির-মতো-কইরা ছালার চট পরা তেল-কালি-লাগার চাইতেও বেশি ময়লা-লাগা একা-একা আধা-ল্যাংটা খালি পা একজনার হেঁটে যাওয়ার পিছন-পিছন ডাইনে-বামে আমার সমান, আমার চেয়ে বেশি-বয়সী অনেকগুলা পোলাপাইন যাইতাছে আর 'পাগল' 'পাগল' বইলা চেঁচাইতাছে, মিছিল করতাছে; নষ্ট-হইয়া-উইঠা-যাওয়া পাকা রাস্তার ছোট ছোট পাথর, খোয়া, রাস্তায় পইড়া পাওয়া সিগারেট, ম্যাচের খালি প্যাকেট, কাগজ দলা পাকাইয়া তার দিকে ছুইড়া মারতাছে-
কোনোটা তার গায়ে লাগতাছে, কোনোটা লাগতাছে না- লক্ষ্যবস্তু কারো দিকে না তাকাইয়া বিভিন্ন স্কেলে 'তোর বাপ পাগল', 'তোর মা পাগল', 'তোর ভাই পাগল', 'তোর বইন পাগল', 'তুই পাগল','তোর চোদ্দগুষ্টি পাগল'-এর এলোমেলো পুনরাবৃত্তি করতে-করতে যাইতেছে তো যাইতেছেই- আমিও ঝাঁকের কৈ-র পিছনে, কিছুদূর আগাইয়া গিয়া প্রাথমিক-স্কুলপাঠ্যের 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'র কথা মনে পইড়া যাওয়ায় ঝাঁকছুট হইছিলাম।
এর পর ওই রকম আর পুরা-ল্যাংটা, পৌনে-ল্যাংটা, আধা-ল্যাংটা কত পাগল(?) দেখছি, দেখতেছি। একবার একজনাকে একটা রাস্তা তাঁর নিজের গতিতেই পার হইতেছে দেখছিলাম, ফলত রাস্তায় জ্যাম; সে পার হবার পর ছোটে। আরেকবার, সর্বোচ্চ সিকিউরিটি ক্রস করে একজনা ঢুইকা পড়ছিলেন একটা ভবনের নিচতলার অনেক ভিতরে এবং একজনের টেবিলে বইসা দুপুরের খাবারসহ-প্লেট টাইনা নিয়া ছুইড়া ফালায় দিতে আর ফালায়দাতাকে অনেকে মিলা উঁচা কইরা ধইরা বাইর কইরা দিতেছে, দেখছিলাম। অন্যবার দেইখা ফালাইছিলাম- যার সঙ্গে অসংখ্যের সমীহ করে চলতে, বলতে হয়; রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়; এমন একজন কেউকেটা পাগলের চইলা আগাইবার রাস্তা ছাইড়া দিছিলেন আর পাগল কয়েক পা আগাইয়া গিয়া ফিরা আইসা তারই মুখমণ্ডলে ছ্যাপ মাইরা আগের গতিতেই আগাইয়া গেছিলেন।...দেখার শেষ অন্ধ হইলেও যাবে না।
মানুষ ও অন্যান্য গৃহপালিত অথবা মুক্ত জীব, কে কেন পাগল বা পাগল হয়, কত প্রকার কী কী হয়- এই ভাবনা, গবেষণা, চিকিৎসা ইত্যাদি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকের। বিশেষজ্ঞের পাগালামির গবেষণা ইত্যাদির নিশ্চয় বিশেষজ্ঞ আছেন।
'হাওয়া বলছে পাগল হবো,
তোমাকে পাগলি বানাবো;
আমি তো সেই কবে নেমেছি,
তোমাকে এইবার নামাবো পথে-
একা-একা ভাল্লাগে না চড়তে উল্টোরথে।
[বয়সের ১৪/১৫'য় গানের জন্য লেখা- ২০০৪-এর পরে সঞ্জীব চৌধুরীর সুরে,বাপ্পা মজুমদারের কম্পোজিশনে গাইছিলেন হাসান মাসুদ]
ছেলেবেলায় পা, হাত, মন, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি দিয়া আগ-বাড়াইবার সময় একটা একতরফা পিরিতের চিপায় পইড়া আমিও অনেকদিন পৃথিবীবিস্মৃত ছিলাম। একতরফার কাহিনী অংশত একটা সিনেমায়, কয়েকটা ভিডিও-ফিকশনে, প্রিন্ট ও ভিজ্যুয়াল-মাধ্যমে [ইন্টার্ভিউতে] এতবার জানাইছি যে, যারা জানেন, তাদের কেউ, অনেকে এই লেখাটা পইড়া বসলে, এই অনুচ্ছেদে আইসা আপনমনে বইলাও উঠতে পারেন- 'আবার!'।
'পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে/...'
-রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর
এক আধা-সরকারি জুটমিলের থার্ডক্লাস ওয়ার্কারের পোলা আমি সেই মিলেরই অন্য শাখার ফার্স্টক্লাস-অফিসারের মাইয়ারে ভালোবাইসা ফালাইছিলাম; ফালাইয়া নিজের স্কুলফিস্কুল ভুইলা গিয়া সেই মাইয়ার স্কুলে যাবার পথের পাশের এক কাঠগোলায় বইসা, স্কুল শুরু হবার আগের টাইমে, ছুটির টাইমে; স্কুলের গেটে গিয়া; খুলনার দৌলতপুরের প্রধান বাসস্টপের কাছে তার গান-শেখার দোতালা-স্কুলের নিচে [সেই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম দিনই বাতিল হইয়া গেছিলাম সারেগামার 'জোরে সা'-বিষয়ক জটিলতায়], তার কোচিং [একবার কোচিং-প্রধানরে রাস্তায় পাইয়া জানতে চাইছিলাম, 'আমারে একটু কোচিং করাবেন?' উনি বলছিলেন, 'আমার এখানে অংক ছাড়া আর কোনো বিষয় নাই', 'আমি অংক করতেই আসবো' বলায় তিনি 'দেখি' বইলা চইলা গেছিলেন। এর পর সেই স্যারের সঙ্গে যতবার দেখা হইছে ততবারই 'দেখি' শোনার পর একদিন একটা খাতা নিয়া কোচিং সেন্টারে গিয়া হাজির হইলে সেই স্যারের ঝাড়ি খাইয়া ফেরত আইছিলাম] করতে যাওয়ার রাস্তায় ভাইগ্নার চা-সিগারেট-টোস্ট বিস্কুটের দোকানে বইসা দাঁড়াইয়া তারে দেখা, ফলো করার প্রায় দেড় বছর পর আমার এই ব্যাপারটা এলাকার নানান জায়গায় বেশি জানাজানি হবার পর আব্বা একটা অফিসিয়াল চাপ খাইছিল। ওই মাইয়ারে ফলো-করা ছাড়তে হবে, না হইলে আব্বা চাকরি হারাবে- এমন এক 'নো ম্যান্স ল্যান্ড'-এ লক খাইয়া এমন হইছিলাম, সেই লকের নামকরণ করা হইছিল, 'পাগল'। আমি আব্বার চাকরিসূত্রে পাওয়া টিনশেডের লম্বা স্টাফ কোয়ার্টারের একবারান্দা, একঘরে দীর্ঘদিন আটকা ছিলাম- নানান উপায়ে [উপায় লিখলে পুরা 'কালের খেয়া' লাইগা যাইতে পারে।] লক ছোটার পর জানলাম, বন্ধুরা আমারে জানলা দিয়া দেখতে আসতো। খাবার দিলে সিগারেট চাইতাম, আব্বা আমারে সিগারেট আইনা দিত। একবার নাকি কীভাবে ঘর থেকে বাইরাইয়া গিয়া কোয়ার্টারের পিছনের অনেক জায়গা জুইড়া বেড়া-দেয়া-কলমি গাছ রামদা দিয়া কাইটা উজাড় কইরা দিছিলাম [লেট এইট্টিজে মারামারিতে আমাদের ওই অঞ্চলে রামদা, ক্ষুর, সেভেন গিয়ার, চায়নিজ কুড়ালের প্রচলন থাকায় সচেতন-সিনিয়রদের কাছে 'গোল্লায় যাওয়া' আমার সংগ্রহেও কোনো-না-কোনোভাবে ওই ধারালো জিনিস ছিল]। আমি অনেকদিন কোনোরকম সবুজ রঙ সহ্য করতে পারতাম না কারণ, আগেও জানতাম না;এখনো জানি না,তবুও মাঝে-মাঝে সবুজ দেখলে এখনো একটু অসহ্য লাগে। একবার ঢাকার এক মেসে থাকার সময় একজনের একটা কড়া-সবুজ বিছানার চাদর বঁটি দিয়া কুচায়া ফেলছিলাম। সেইটা নিয়া অনেক কাহিনী এবং মেস-ছাড়া। সহ্য আনার জন্য আমি নানানরকম সবুজ টি শার্ট পরতাম, পরি, পরবো।... এই লেখার এইখানে আইসা ৮ দিকে তাকাইয়া তিরোধিত আব্বার কাছে একবার 'সরি' চাওয়া যাক- 'সরি আব্বা'।
ফুল ছিঁড়ে নিয়ে গেছে কেউ,- আমি এখন বোঁটা ছিঁড়বো
[হাতে না পারলে দাঁতে]?
'পাগল' শব্দটা মুখ দিয়ে বের করে
কোথায় পাঠিয়ে দাও?
[আমার কবিতাবই 'বাইজিবাড়ি রোড'-এর 'কেউ ফেরে না খালি হাতে, আমিও']
ম্যাডনেস ও ক্রিয়েটিভিটি
'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।/...
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে.../
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে/...।'
-কাজী নজরুল ইসলাম
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়ায় [২৪ মে, ১৮৯৯ ] জন্মাইয়া মহান দারিদ্র্যর আশীর্বাদে [?] ছেলেবেলাতেই রুটির দোকানে কাম, আজান দেয়া, কবরস্থানের খাদেম, লেটোর দলে গানবাজনাসহ [সোকল্ড রাইজিং আরবানরা যেসব কাজরে নাক সিটকাইয়া 'অড জব' কইয়া থাকে] নানানরকম জীবনযাপনের ভিতর দিয়া প্রেম, কবিতা, গান [সুর, সঙ্গীত, সঙ্গীতের অজস্র রাগ সৃষ্টি], গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, প্রকাশনা, সিনেমা, রাজনীতি, রেডিও, জেলজুলুম-নির্বাচন-হুলিয়াসহ অনেক-কিছু করার মতো কইরাই কিংবদন্তি কাজী নজরুল ইসলাম। পাগল না হইলে অত-কিছু করা যায়? গান দিয়া পরমপুরুষের স্ববিরোধ [ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে] নানান জায়গায় আঙুল দিয়া দেখায় দেয়া যায়? বিদ্রোহ কইত্তে আসে? অত-কিছু করা যায়? লেইখা-বলা যায়,- 'আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ',... 'আমি মানি না কো কোন আইন', 'খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর',...'আমি ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন'...?
আমার ধারণা [কারো-কারো কাছে বালসুলভও লাগতে পারে], অত-কিছুর লোড নেয়ায় ১৯৪২-এ 'সাম্যের গান গাওয়া' নজরুল সিক হইয়া পইড়া কথা-বলতে-পারার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলায় হোমিওপ্যাথি,আয়ুর্বেদের চিকিৎসা-চালুর ভিতর একই বছর-শেষে মানসিক ভারসাম্যও হারান। চিকিৎসা কমিটিটমিটি হয়- প্রথমে লন্ডন, পরে ভিয়েনার চিকিৎসায় জানা যায়, কবি 'পিক্স ডিজিজ' নামে নিউরনঘটিত সমস্যায় ভুগতেছেন- এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিস্কের ফ্রন্টাল ও পাশের লোব সংকুচিত হয়। ১৯৭২-এর ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়া নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয় এবং তাঁর ভারসাম্যহীন-মস্তিস্কের জীবন বাংলাদেশে কাটতে থাকে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাবার পরেও মিনিমাম স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে আর ফেরানো যায় নাই। ১৯৭৬-এর ২৯ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। এই ১৯৭৬-এই নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার সরকারি আদেশ জারি হয়।...
পাগল বোঝে পাগলরে
নজরুলের জীবন আর কাজের প্রভাব তাঁর পরবর্তী প্রায় প্রত্যেক বাঙালি কবি-লেখকের, পাঠকের জীবনে এবং কাজে ছিল, আছে, থাকবে। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতার বই 'ঝরা পালক' নজরুলপ্রভাবধন্য।
হিন্দি সিনেমার উর্দু-হিন্দি লিরিসিস্ট, ফিল্মমেকার, চিত্রনাট্যকার- ২০০৮-এ 'জয় হো' লিরিক্সের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-পাওয়া গুলজার- ভিজুয়াল এক ইন্টার্ভিউতে বলছিলেন, তাঁকে নজরুলের লেখা কীভাবে ইন্সপায়ার করছিল। ... রবীন্দ্রনাথের একটা বই [উর্দু তরজমা] তাঁর জীবন কীভাবে বদলাইয়া দিছিল। ...শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সুবোধ [ঘোষ]-দের পড়ার জন্যই তিনি বাংলা শিখেছিলেন। তাঁর বানানো সিনেমার অধিকাংশই বাংলা সাহিত্যের এইসব মহারথীর গল্প-উপন্যাসনির্ভর।
এই অধমও ছেলেবেলার পাঠ্যপুস্তকে অন্যদের পাশাপাশি নজরুলরেও খালি পরীক্ষাপাশের জন্য না-পইড়া নিজেরে পড়াইছিলো বইলা, একাডেমিক শিক্ষারে সাইড কইরা নিজের রাস্তা নিজে বানাইয়া, সেই রাস্তায় চলতে-চলতে মন-শরীরের ৪৫+ ঝঃধঃরড়হ-এ আইসা এই লেখা লিখতে পারার ট্রাই করলো।
'.../ সকল লোকের মাঝে বসে /আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?/...'
[বোধ (কবিতা-অংশ), জীবনানন্দ দাশ]
বাংলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মাইছিলেন বরিশালে [১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯]। তারপর অনেকবার কোলকাতা-বরিশাল-কোলকাতা করার ফাঁকে বিয়া করছিলেন পুরান ঢাকায়। সো কল্ড কেরানি হইয়া না-যাওয়ায় তাঁর কর্ম ও বৈবাহিক জীবনে অস্বস্তি ছিল। নিজস্ব জীবনযাপনের ধরন, লেখকের জীবনদর্শন [ভালো লিখতে হলে, অন্তত এখন পর্যন্ত এ-দেশে, বেঁচে থাকবার সহজ সাফল্যগুলো সব ছাড়তে শিখতে হয়, অনেকটা কাপালিকের মতো হয়ে যেতে হয়। সামনে কিছু নেই, থাকবার আশাও নেই, কিন্তু তুই তবু থেকে যাচ্ছিস বা থাকবার জন্য আপ্রাণ করছিস।...'- ভূমেন্দ্র গুহকে [যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শস্ত্র চিকিৎসায় মাস্টার অব সার্জারি, বিশেষভাবে 'বক্ষদেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হূৎপিণ্ড ও সর্বশরীরের ধমনী-শিরার শস্ত্র চিকিৎসাবিদ্যায় এম.সি-এইচ; কবিতা, প্রবন্ধ লিখছেন; অনুবাদ করেছেন, বিখ্যাত 'ময়ুখ', 'অনুক্ত' পত্রিকা সম্পাদনায় সংশ্নিষ্ট ছিলেন; জীবনানন্দের মৃত্যুপরবর্তী প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনা সংবলিত বইগুলা প্রকাশ করায় ভূমিকা রাখছেন] জীবনানন্দ।] আর কবিতায় নিজের ভাষা-পথ নিজে বানাইয়া নেয়ায় তাঁর সমসাময়িক অনেকেই তাঁকে নিয়ে উপহাস, তাচ্ছিল্য ইত্যাদি করত- সেসব শুধু মুখে মুখে বা আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকত না, লিখেও তারে আহত করা হইছে- 'পাগল' বইলাও ডাকা হইছে আমরা বুঝতে পারি।
আলাদা লিখলেই পাগল! আলাদা বা নিজস্ব জীবনযাপনপদ্ধতিতে কেউ বাইচা থাকতে চাইয়া পারলেই সে পাগল!...জীবনানন্দবিষয়ে অনেক বই পড়া থেকে জানা যায়, কবিতায় তাঁর সমকালীন ও পরবর্তী জেনারেশনের অনেকে, যারা তাঁরে নানানভাবে অপমানসহ এড়াইয়া চলছিলেন, তাদের বড় একটা অংশ পরে একে একে তাঁর কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনাকে প্রাতঃস্মরণীয় করে বেঁচে ছিলেন, আছেনও কেউ-কেউ। 'অচেনা লেখা যে লিখবে সে পাগল'- যে বা যাঁহারা (সেইসব শেয়াল) এইসব নির্দিষ্ট কইরা দিয়া মরছেন, তাদের ভূত দুনিয়া জুইড়া শেষপর্যন্ত থাকবে।
কাকে তুমি ডাকো ফুল? নিশ্চয় আমাকে।
কাকে? আমি এই ঘরে থাকি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে
তেইশ ঘণ্টাই একা একা, বাকি এক ঘণ্টা থাকি
বাড়ির বাইরে ওই চায়ের দোকানে
মেলামেশা করি সব দেবতাদিগের সঙ্গে।
[আমিই গণিতের শূন্য, বিনয় মজুমদার]
বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়া কথা-লেখার সাহস আমার নাই; হবেও না আগামীতে। বাংলা ভাষার সাধারণ পাঠকের চেয়ে তাঁর কবিতা, দর্শন, জীবনযাপন তাঁর সময়ের ও পরের পরের পরের প্রজন্মের কবি-লেখকদের কাছে ক্রমবর্ধমান কিংবদন্তি। তাঁর প্রথমদিকের কবিতায় জীবনানন্দ দাশের প্রভাব থাকলে অসুবিধা কী?
বার্মার [এখন মিয়ানমার] মিকটিলা জেলার তেডো শহরে ১৯৩৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বরে জন্মান- পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আক্রমণে আতঙ্কিত পরিবার উদ্বাস্তু হইয়া বার্মা ছাইড়া মাতৃ-পিতৃভূমি অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের [এখন তো বাংলাদেশ] ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার [এখন জেলা] মাঝিগাতি-তারাইলে আইসা ওঠেন। এইখানকার বৌলতলি উচ্চ ইংরেজি স্কুলে পড়ার সময়ে, ১৩ বছর বয়স থিকা কবিতা লেখা আরম্ভ করেন; ১৯৪৭ সালে এই স্কুলের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪৭-এর এক সময় মাঝিগাতি-তারাইল থিকাও চইলা যাইতে হয় পশ্চিমবঙ্গের শিমুলপুরে-...
বিনয়ের প্রথম কবিতার বই 'নক্ষত্রের আলোয়' [১৩৬৫ বঙ্গাব্দ],পরেরটা 'গায়ত্রীকে' [২৪ ফাল্গুন, ১৩৬৭] ১৯৬৪-তে 'দ্য স্টেটসম্যান' দৈনিকে বিনয়ের কবিতার তৃতীয় বই 'ফিরে এসো চাকা' নিয়া আলোচনা প্রকাশিত হওয়ার পর কোলকাতায় হইচই পইড়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হইয়া যায়। রুশ ভাষার ৫টা বই অনুবাদ কইরা খ্যাতি অর্জন করছিলেন এরও অনেক আগে।
১২ বছরের 'গায়ত্রী'র প্রেমে একতরফা পইড়া থাকতে-থাকতে ২৩ বছর বয়সে ইংরেজি এম.এ.তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইয়া ফেলোশিপ পাইয়া গায়ত্রী উত্তর-আমেরিকায় চইলা গেলে বিনয়ের আচরণে বদল দেখা দেয়। 'ফিরে এসো চাকা' বের হবার আগেই কবি মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া আচরণে অসংলগ্নতা শুরু করেন- কোনো চিকিৎসাই তাঁর তিরোধানের আগেও সেইটা সংলগ্ন করতে পারে নাই।
তাঁরে নিয়া হাসিঠাট্টা করায় ১৯৭১-এর কোনো-একদিন বিনয় মেসের ঠাকুরের [ম্যানেজার] মাথায় দরোজার খিল ছুইড়া মারলে তার মাথা ফাইটা যায়। পুলিশ আইসা বিনয়রে অ্যারেস্ট কইরা চালান দিয়া দেয়।
পৈতৃক ভিটার টানে সীমান্ত আইন না মাইনা ভিসা, পাসপোর্ট-ফাসপোর্ট ছাড়া একবার বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুইকা পইড়া ৬ মাস জেল খাইটা ফেরত গেছিলেন- এই সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণও করতে চাইছিলেন [পরে আর করেন নাই]। চিকিৎসার নামে তাঁর স্বজনরা [?] বারবার মানসিক হাসপাতালে [অন্তত ৮ বার] নিয়া গিয়া রাইখা আইছে বিনয়রে- ১৮ বার ইলেকট্রিক শকও দেয়া হইছে তাঁরে। একবার বিড়ি খাইতে-খাইতে জ্বলন্ত বিড়ি ছুইড়া মারছিলেন মশারিতে- আগুন ধইরা গেছিল- পরপরই বিনয়কে আবারও অ্যাসাইলামে যাইতে হয়।...
একবার তাঁকে এক মানসিক হাসপাতালে ঠেইলা পাঠাইলে দেখা হইয়া যায়, তাঁর আগে গিয়া থাকা ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। এই হাসপাতালেই ঋত্বিক তাঁর রচিত-নির্দেশিত 'জ্বালা' নাটক মঞ্চস্থ কইরা বিনয়রে দিয়াও অভিনয় করান। ...বিনয় সম্পর্কে এইরকম ইনফো বহুত দেয়া যায়। আর পারতেছি না, খারাপ লাগতেছে।
ওই অবস্থার ভিতরেও পরপর বিনয় লেইখা রাখছেন কবিতার বই 'অধিকন্তু', 'অঘ্রানের অনুভূতিমালা', 'ঈশ্বরীর', 'বাল্মীকির কবিতা', 'আমাদের বাগানে', 'আমি এই সভায়', 'আমাকেও মনে রেখো', 'আমিই গণিতের শূন্য', 'এখন দ্বিতীয় শৈশবে', 'কবিতা বুঝিনি আমি'; গদ্যের বই 'ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ ও অন্যান্য', 'ধূসর জীবনানন্দ'।
বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, রুশ, সিন্ধি, বর্মা ভাষা জানা, গণিতশাস্ত্রের চর্চা করা, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গোল্ড-মেডেলিস্ট, ইঞ্জিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করা কবি বিনয় মজুমদার তাঁর জীবনের করুণ পরিণতির জন্য 'হাঙর'দের দায়ী করে গেছেন এক সাক্ষাৎকারে- 'হাঙর মানে মনস্তত্ত্ববিদ, হাঙর মানে ডাক্তারগণ, হাঙর মানে পুলিশগণ, হাঙর মানে মন্ত্রীগণ, হাঙর মানে পুরোহিতগণ। এই হাঙরদের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বেরিয়ে আসার জোগাড়।'... 'ওরা সব ভ ুল করে দিয়েছে'... এর সঙ্গে আছেন সমাজপতি, কবিতাপতি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। আড়াই মাস ধরে কবি মৃদুল দাশগুপ্তর নেয়া এই সাক্ষাৎকারের অল্প অংশ ছাপা হইছিল 'নৌকা' নামের লিটলম্যাগে।
যৌক্তিক সত্যিকথা যে বলে, সে পাগল
'তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।'
-লালন ফকির
লেখাটা মগজে যেইভাবে কমপ্লিট হইছিল, সেইভাবে লেইখা কমপ্লিট করতে পারলাম না।
মগজে এসএম সুলতান ছিল, ছিল ঋত্বিক ঘটক, ভ্যানগগ, বোদলেয়ার, র?্যাঁবো, গ্যালিলিও, মির্জা গালিব, জিম মরিসন, শোয়েব শাদাব, মাহমুদুল হক, ফ্রানজ কাফকা, লালন ফকির...
ওনাদের বা ওনাদের মতোন আরো অনেকরে নিয়া উল্লিখিত-রকমে লিখতে গেলে আমার মতো কাছিমের দীর্ঘ দিনরাইত লাগবে।
ধন্যবাদ চাঁদ-সূর্যকে, মেঘ-বৃষ্টিকে, গরমকে, ইলেক্ট্রিসিটিকে, ল্যাপটপকে, গুগলকে, ২ আঙ্গুল দুধ-চা ও সিগারেট-আগুনকে, অজস্র বই-পত্রপত্রিকাকে, লাচ্ছা সেমাইকে, চানাচুরকে, কলাকে, আমকে, ডাবকে...এবং আরো যাদের কথা মনে পড়তেছে, লিখতে পারতেছি না- আমারে প্রায় ৭২ ঘণ্টা জাগাইয়া রাইখা আলস্যসহযোগে এই লেখাটা এইভাবে লিখতে সাহায্য করার জন্য সবাইরে ধন্যবাদ।
No comments